প্রকাশিতঃ সোমবার, এপ্রিল ১৮, ২০২২ পঠিতঃ 33642
১৩ এপ্রিল রাজধানীর একটি হোটেলে ব্র্যাক, সেভ দ্য চিলড্রেন, ব্রিটিশ কাউন্সিল, প্লান বাংলাদেশসহ ২১টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার 'নিরাপদে স্কুলে ফিরি' ক্যাম্পেইনের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গবেষণায় উঠে এসেছে করোনার দীর্ঘ দেড় বছর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেও স্কুলে উপস্থিতি অনেক কম এবং অনেক শিক্ষার্থীই আর স্কুলে ফিরে আসেনি। মাধ্যমিকে গড় উপস্থিতির হার ৫৭ থেকে ৬৯ শতাংশ এবং প্রাথমিকে ৬৫ থেকে ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ শ্রেণিভেদে মাধ্যমিকে ৪৩ থেকে ৩১ শতাংশ এবং প্রাথমিকে ৩৫ থেকে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে আসছে না।
২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ৭টি বিভাগের ১৭টি জেলার ৩২৮টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১,৬০৬ শিক্ষার্থীর ওপর তিন সপ্তাহের সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রাথমিকে সর্বনিম্ন উপস্থিতি ছিল চতুর্থ শ্রেণিতে (৬৫% শতাংশ) এবং সর্বোচ্চ প্রথম শ্রেণিতে (৮৬ শতাংশ)। মাধ্যমিকে সর্বনিম্ন উপস্থিতি ছিল নবম শ্রেণিতে (৫৭ শতাংশ) এবং সর্বোচ্চ ছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে (৬৯ শতাংশ)। শ্রেণিতে উপস্থিতির হার ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলেরা ১৬ থেকে ৩৭ শতাংশ এবং মেয়েরা ১৪ থেকে ৩৫ শতাংশ অনুপস্থিত ছিল। মাধ্যমিকে ছেলেরা ৩৪ থেকে ৪৫ শতাংশ এবং মেয়েরা ২৮ থেকে ৪১ শতাংশ অনুপস্থিত ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে চতুর্থ শ্রেণিতে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে নবম শ্রেণিতে উপস্থিতি সবচেয়ে কম ছিল। গবেষণায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির ৫টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া, বাল্যবিবাহ, পরিবারের অন্য জায়গায় স্থানান্তর, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসায় স্থানান্তর এবং অধ্যয়নে আগ্রহ হ্রাস।
গবেষণায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে ৩টি সুপারিশ করা হয়। এগুলো ১. ক্লাসে অনিয়মিত ছেলেদের জন্য উচ্চ হারে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা। ২. বাল্যবিবাহ রোধে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় মেয়েদের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া। বিবাহিত মেয়েদের শিক্ষা চালিয়ে নেওয়ার জন্য উচ্চ হারে আর্থিক সহায়তা বা উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা। ৩. ড্রপ-আউট শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, ' প্রতিটি উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে শিক্ষা কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার ও এনজিও প্রতিনিধির একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ করা যেতে পারে। তারা ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করে স্কুলে ফিরিয়ে আনবে। এজন্য অবশ্যই বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।
গবেষণায় শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণে ৪টি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১. শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণে তাদের জন্য পরিপূরক প্রতিকারমূলক ক্লাসের ব্যবস্থা করা। ২. একটি মিশ্র শেখার প্রক্রিয়া চালু করা উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা নতুন পাঠের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে- এই পদ্ধতিতে তাদের জন্য পূর্ববর্তী ক্লাসগুলি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, স্কুল বন্ধের কারণে যা তারা মিস করেছ। ৩. প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের পরিপূরক এবং মিশ্রিত শিক্ষণ পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত করা। বেসরকারী সংস্থাগুলি সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে। ৪. স্কুলগুলোকে কীভাবে পরিপূরক প্রতিকারমূলক ক্লাস নেওয়া যায় বা মিশ্র পদ্ধতির মাধ্যমে শেখার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা যায় সে বিষয়ে সরকারিভাবে নির্দেশনা দেওয়া।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হবে। সরকারের অনেক গবেষণা ফলাফলের সঙ্গেই এই গবেষণা মিলে গেছে। যারা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তাদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে একদম তৃণমূলে গিয়ে কাজ করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে কাজ করবো বলে ২ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করেছি। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত দুজন কাউন্সিলিংয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক থাকবেন। আর প্রতিটি জেলায় একজন করে পেশাদার কাউন্সিলর থাকবে। সবাই মিলে কাজ করলে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা অবশ্যই পূরণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে আমরা মনে করি।'
এখন আমাদের প্রধান কাজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৪-৩৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৩১-৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা। শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে সরকারি-বেসরকারিভাবে সমন্বয় সাধন করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ বা নামমাত্র বেতন, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা এবং ঝরেপড়া ও বিবাহিত শিক্ষার্থীদের পরিবারকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় এনে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষকদেরও মোটিভেশনাল ও প্যাডাগজি প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং অতিরিক্ত ক্লাসের জন্য ইনসেনটিভ দিতে হবে।
লেখক: এম এ আলিম খান, বেসরকারি সংস্থা ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশের সহকারী কান্ট্রি ডিরেক্টর।
কামরুজ্জামান রাজু / কামরুজ্জামান রাজু